ancientbuddhism.files.wordpress.com · web viewত , বইট ত শ খ র মত প রচ...

1589
†eŠ× wfÿz wewa (wØZxq LÐ) ববববব বববববব বববব (দদদদদদদ দদদদ) 1

Upload: others

Post on 07-Mar-2020

6 views

Category:

Documents


0 download

TRANSCRIPT

PAGE

3

†eŠ× wfÿz wewa (wØZxq LÐ)

বৌদ্ধ ভিক্ষু বিধি

(দ্বিতীয় খণ্ড)

বৌদ্ধ ভিক্ষু বিধি

(দ্বিতীয় খণ্ড)

খন্ধকের বিধিগুলোর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা

মূল : ঠানিস্সারো ভিক্ষু (জেফ্রি ডিগ্রাফ)

বাংলা অনুবাদ : জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু

বৌদ্ধ ভিক্ষু বিধি - দ্বিতীয় খণ্ড (বৌভিবি-২)

মূল : ঠানিস্সারো ভিক্ষু (জেফ্রি ডিগ্রাফ)

বাংলা অনুবাদ : জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু

বাংলা অনুবাদ MÖš’¯^Z¡ : অনুবাদক

evsjvq cÖ_g cÖKvk : 1422 e½vã; 8 Rvbyqvwi, 2015 wLªóvã

cÖKvkK : ২০১৫ সালে স্থবিরপদে উন্নীত হওয়া বনভন্তের শিষ্য ভিক্ষুবৃন্দ

cÖ”Q` cwiKíbvq : সুভাবিতো wfÿz

gy`ªY : ivReb Ad‡mU †cÖm, ivOvgvwU

Buddhist Monastic Code Volume 2 (BMC2)

(3rd Revised Edition, 2013)

by Thanissaro Bhikkhu (Geoffrey DeGraff)

Translated by GanSanto Bhikkhu

প্রচ্ছদের ছবি : মায়ানমারের পা-অক বনবিহারে উপোসথরত ভিক্ষুসংঘ।

‘এখন, আনন্দ, তোমাদের কারো কাছে যদি এমন মনে হয়—শিক্ষা তার কর্তাকে হারিয়েছে, আমরা শাস্তাবিহীন—এটিকে সেভাবে দেখবে না। যে ধর্ম ও বিনয় আমি দেখিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি, আমি চলে গেলে তা-ই হবে তোমাদের শাস্তা।’

—দীর্ঘনিকায়, মহাপরিনির্বাণ-সূত্র

*** রেফারেন্স ***

রেফারেন্স : ষষ্ঠ সঙ্গায়নের পালি ত্রিপিটক

বিনয়পিটকের গ্রন্থগুলোর রেফারেন্স :

মৰ. = মহাৰগ্গ (যেমন—মৰ.৩০৫ মানে হচ্ছে মহাবগ্গ ৩০৫ নং অনুচ্ছেদ)

চুৰ. = চুলৰগ্গ (যেমন—চুৰ.৪০৬ মানে হচ্ছে চুলবগ্গ ৪০৬ নং অনুচ্ছেদ)

পরি. = পরিৰার (যেমন—পরি.৩৬৬ মানে হচ্ছে পরিবার গ্রন্থের ৩৬৬ নং অনুচ্ছেদ)

সূত্রপিটকের গ্রন্থগুলোর রেফারেন্স :

দী.নি. = দীর্ঘনিকায় (যেমন—দী.নি.২.২ মানে হচ্ছে দীর্ঘনিকায়ের ২নং খণ্ডের ২ নং সূত্র)

ম.নি. = মধ্যমনিকায় (যেমন—ম.নি. ৩.৫.১ মানে হচ্ছে মধ্যমনিকায়ের ৩য় খণ্ডের ৫ম বর্গের ১নং সূত্র)

স.নি. = সংযুক্তনিকায় (যেমন—স.নি. ৪.২.১.৭ মানে হচ্ছে সংযুক্তনিকায়ের ৪র্থ খণ্ডের ২নং সংযুক্তের ১ নং বর্গের ৭নং সূত্র)

** ব্যতিক্রম : সংযুক্তনিকায়ের ৩য় খণ্ডের ক্ষেত্রে, স.নি.৩.৪.১ মানে হচ্ছে সংযুক্তনিকায়ের ৩য় খণ্ডের ৪নং সংযুক্তের ১নং সূত্র।

অ.নি. = অঙ্গুত্তরনিকায় (যেমন—অ.নি. ৬.২.৬ মানে হচ্ছে অঙ্গুত্তরনিকায়ের ৬ষ্ঠ নিপাতের ২নং বর্গের ৬ নং সূত্র)

ধম্মপদের রেফারেন্স নম্বরগুলো গাথাকে নির্দেশ করে।

প্রকাশকবৃন্দের কথা

পালি অর্থকথা সাহিত্য পড়লে আমরা দেখতে পাই সেখানে বলা হয়েছে : বিনযস্স নাম সাসনস্স আযু—বিনয় হচ্ছে বুদ্ধশাসনের আয়ুর মতো। ভিক্ষু-গৃহীর মাঝে বুদ্ধ-প্রজ্ঞাপিত তথা বুদ্ধ-উপদিষ্ট বিনয়নীতি কতটুকু চর্চা হয় তার উপরই নির্ভর করে আসলে এই পৃথিবীর বুকে বুদ্ধের শাসন কতদিন টিকে থাকবে। মূলত প্রত্যেক বৌদ্ধ আপনাপন জীবনে এই বিনয়নীতি চর্চার মধ্য দিয়েই বুদ্ধের পবিত্র শাসনকে এই পৃথিবীর বুকে জিইয়ে রাখেন। তাই প্রকৃত বৌদ্ধরা আপনাপন জীবনে যতদিন বুদ্ধের উপদেশ তথা বিনয়নীতিকে লালন করবে, চর্চা করবে, ততদিন পর্যন্ত বুদ্ধের শাসন সদর্পে টিকে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিনয়, সূত্র ও অভিধর্ম এই ত্রিপিটকের মধ্যে বিনয়পিটক মোট পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত। সেই পাঁচ খণ্ড বিনয় হচ্ছে, পারাজিকা, পাচিত্তিয়, মহাবর্গ, চূলবর্গ ও পরিবার। এই পাঁচ খণ্ড বিনয়পিটকের সবকটি ইতিমধ্যেই বাংলায় অনূদিত হয়েছে। বিনয়পিটকের পূর্ণাঙ্গ অর্থকথা এখনো বাংলায় অনূদিত হয়নি। তবে বিগত মাস দুয়েক আগে এই প্রথম দুই খণ্ডবিশিষ্ট পারাজিকা-অর্থকথা-র প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছে। বাকিগুলোও ক্রমান্বয়ে অনুবাদের জন্য অভিজ্ঞ অনুবাদকদের অনুরোধ জানাই।

সমগ্র বিনয়পিটক বাংলায় অনূদিত হলেও অর্থকথার অনুবাদ না হওয়ায় ভিক্ষুসংঘের মধ্যে বিনয়-বিষয়ে এখনো অনেক অস্পষ্টতা বিদ্যমান। বিনয়ের অনেক বিষয়ে অনেক প্রবীন ভিক্ষুদের জিজ্ঞেস করেও এখনো সন্তোষজনক সদু্ত্তর পাওয়া যায় না। আর কোনো অভিজ্ঞ ভিক্ষুও এখনো সমগ্র বিনয়পিটক, অর্থকথা, টীকা প্রভৃতি বই পড়ে গবেষণা করে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে সহজবোধ্য কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। বাংলায় এমন গবেষণামূলক বই লেখা না হলেও ইংরেজিতে থাইল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থানরত ভদন্ত ঠানিস্সরো ভিক্ষু Buddhist Monastic Code নামে দুই খণ্ডে বিভক্ত বিশাল একটি বই রচনা করেন। তিনি এই বইটিতে যতটুকু সম্ভব বিনয়ের সমস্ত বিষয়গুলোকে নানান বই থেকে কুড়িয়ে এনে অনেক গবেষণা করে এক জায়গায় গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এতে ইংরেজি ভাষী ভিক্ষুসংঘের বিনয় বিষয়ে অস্পষ্টতা অনেকাংশে দূর হয়েছে।

পরম সুখের কথা হচ্ছে, ভদন্ত ঠানিস্সরো ভিক্ষুর উক্ত মূল্যবান ও বিশাল বইটি বৌদ্ধ ভিক্ষু বিধি (দুই খণ্ড) নাম দিয়ে আমাদের অত্যন্ত স্নেহভাজন জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু অনেক আয়াস স্বীকার করে সহজবোধ্য প্রাঞ্জল বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তিনি ইতিমধ্যেই হৃদয়ের দরজা খুলে দিন-সহ বেশ কয়েকটি বই বাংলায় অনুবাদ করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর এই বইটিও বিনয়গারবী ভিক্ষুসংঘের অনেক উপকারে আসবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। বাংলার বৌদ্ধ ইতিহাসে তাঁর নাম উজ্জ্বল স্বর্ণাক্ষরে অক্ষয় হয়ে লেখা থাকবে। আমরা তাঁর উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি এবং সেই সাথে ইহজীবনেই যাতে তিনি সর্বাসব ক্ষয় করে অজর অমর নির্বাণ লাভ করতে পারেন, এই প্রার্থনা করি।

এমন একটি মূল্যবান বই প্রকাশে সহায়তা করার জন্য আমাদের প্রথম অনুরোধ জানান শ্রদ্ধেয় বিধুর মহাস্থবির ভন্তে। তাঁর সস্নেহ অনুরোধে পূজ্য বনভন্তের শিষ্যসংঘের মধ্যে আমরা যারা এই বছর বিনয় অনুযায়ী স্থবিরপদে উন্নীত হয়েছি তারা সবাই মিলে আলোচনা করে বেশ আনন্দের সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষু বিধি (দ্বিতীয় খণ্ড) বইটি প্রকাশের দায়িত্বভার গ্রহণ করি। বহু তত্ত্ব ও তথ্যে সমৃদ্ধ গবেষণামূলক এমন একটি মূল্যবান বই প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ায় আমরা শ্রদ্ধেয় বিধুর ভন্তের নিকট অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। উল্লেখ্য, আমাদের এই প্রকাশনা কাজে শ্রদ্ধেয় বিধুর ভন্তের সহায়তায় কয়েকজন উপাসিকা অর্থসহায়তা করেছেন তারা হলেন মিস পূর্ণতা চাকমা (১০,০০০/-), বটতলা, তবলছড়ি, রাঙামাটি; মিসেস কৃষ্ণা চাকমা (৫,০০০/-), বটতলা, তবলছড়ি, রাঙামাটি; মিসেস কবিতা চাকমা (৫,০০০/-), আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম এবং স্নেহভাজন বিমুক্তিসার ভিক্ষুর সহায়তায় তার জ্ঞাতি বোনঝি (ভাগিনা) ভারতের মিস লুম্বিনী উন্নতি চাকমা (৫,০০০/-)। ধর্মীয় বই প্রকাশ জাতীয় মহতী পুণ্যকাজে অর্থসহায়তা করায় আমরা তাদের সবাইকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।

পরিশেষে, এই বইটি যদি দুঃখমুক্তিকামী বিনয়গারবী ভিক্ষুগণের বিনয় বিষয়ে যাবতীয় অস্বচ্ছ ধারণা ও অস্পষ্টতা দূর করে বিনয়ানুগ আদর্শ জীবন গঠনে কিছুটা হলেও সহায়তা করে, তাহলেই কেবল আমাদের সমস্ত অর্থব্যয় সার্থক মনে করবো। এই বইটি প্রকাশজনিত পুণ্যের ফলে আমাদের ও প্রকাশের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের যাবতীয় অবিদ্যা-তৃষ্ণা ক্ষয় হয়ে অজর অমর পরমা শান্তি নির্বাণ লাভের হেতু হোক, এই প্রার্থনা করছি।

বিনীত

২০১৫ সালে স্থবিরপদে উন্নীত হওয়া

বনভন্তের শিষ্য ভিক্ষুবৃন্দ

২৬ অক্টোবর, ২০১৫

অনুবাদকের কথা

গৌতম সম্যকসম্বুদ্ধকে মাথা নত করে বন্দনা করছি।

আরো বন্দনা করছি শ্রদ্ধেয় বনভান্তেকে।

আর সেই সাথে বন্দনা করছি আমার প্রব্রজ্যা দীক্ষাগুরু শ্রদ্ধেয় করুণাকীর্তি স্থবির ভান্তেকে। তার আশীর্বাদেই আমার এই প্রব্রজ্যা জীবনের শুরু।

আমি বিনয় বিশারদ নই, বিনয়ের একজন নবীন শিক্ষার্থী মাত্র। আর আমি পেশাদার অনুবাদকও নই, শুধুমাত্র বিনয় শিক্ষা ও তার প্রতিপালনে সহায়ক হবে বলেই এই বড়সড় অনুবাদের কাজে হাত দেওয়া। তাই আগেই বলে রাখছি, এই বই পড়ে বিনয় বিষয়ে কারো কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে, মতামত থাকলে, অভিযোগ থাকলে, অথবা প্রশংসা থাকলে তা এই বইয়ের মূল লেখক ঠানিস্সারো ভান্তেকেই জানানো উচিত, আমাকে নয়।

অনুবাদ কীভাবে করেছি একটু বলি। ভিক্ষু হওয়ার পর থেকেই আমার মনে হয়েছিল এই বই দুটো অনুবাদ করা উচিত। কিন্তু বইগুলোর বিশালত্ব দেখে আমি প্রায়ই নিরুৎসাহিত হতাম, এত বড় বড় দুটো বই কীভাবে অনুবাদ করবো? মাথা তো খারাপ হয়ে যাবে! কিন্তু শ্রদ্ধেয় করুণাবংশ ভান্তের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে মনে একটু জোর পেলাম, দেখা যাক তাহলে। এরপর আমেরিকায় ঠানিস্সারো ভান্তেকে চিঠি লিখলাম, সেটা লক্ষীছড়ির পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি করে পাঠানো হলো। এই পোস্ট অফিসের কাজকারবার নিয়ে আমার বরাবরই সন্দেহ হয়। তাদের যে বেহাল দশা, চিঠিটা ঠিকঠাক পৌঁছে দেবে তো! আমরা ভেবেছি, চিঠির উত্তর পেতে কয়েক মাস বা বছরও লাগতে পারে, আর অনুবাদের অনুমতি দিলেও যদি কোনো শর্ত জুড়ে দেন ঠানিস্সারো ভান্তে, তাহলেই সেরেছে! কিন্তু আমরা সাহস করে চিঠিটি পাঠালাম। মাস দুয়েকের মধ্যেই আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে ঠানিস্সারো ভান্তের কাছ থেকে একটা প্যাকেট এলো রাজবনবিহারে। সেখানে শ্রদ্ধেয় জ্ঞানলোক ভান্তে দুরুদুরু বুকে প্যাকেট খুললেন, দেখলেন একগাদা ইংরেজি বই, আর সাথে অনুবাদের অনুমতি দিয়ে দুইতিন লাইনের সংক্ষিপ্ত একটা চিঠি। আমার তখন খুশিতে লাফানো বাকি! (আমি ঠিক নিশ্চিত নই ভিক্ষুরা খুশি হলে লাফাতে পারে কিনা, তাই কোনোমতে সংযত হলাম আর কি!)

সবচেয়ে খুশি হলাম ঠানিস্সারো ভান্তে সম্প্রতি আমেরিকায় প্রকাশিত BMC1 এবং BMC2 বই দুটোর সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণের দুটো সেট আমাদেরকে পাঠিয়েছেন, এবং অনুমতি মিলেছে নিঃশর্তে, নো স্ট্রিং এটাচ্ড্। ইয়াহু!

এই দুটো খণ্ডের অনুবাদ শুরু করেছিলাম ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে, মহালছড়ির করল্যাছড়িতে অবস্থিত সারনাথ বনবিহার থেকে। ফেব্রুয়ারিতে গেলাম লক্ষীছড়ির কুশীনগর বনবিহারে। সেখান থেকেই আমরা আমেরিকায় ঠানিস্সারো ভান্তেকে চিঠি লিখেছিলাম। সেখানে তিন মাসের মতো কাটিয়ে এপ্রিলের শেষের দিকে গেলাম জুরাছড়ির আমতলী ধর্মোদয় বনবিহারে। সেখানে বর্ষাবাস কাটিয়ে নভেম্বরে গেলাম বান্দরবানের বনবিহারে। এভাবে অনেক বিহার ঘুরে ঘুরে অবশেষে বান্দরবানে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে অনুবাদের কাজ সমাপ্ত করা গেল।

মূল বইয়ে ঠানিস্সারো ভান্তের ইংরেজি বাক্যগুলো খুব লম্বা লম্বা। সেখানে আছে কমা, সেমিকোলন, কয়েক ধরনের ড্যাশ, (সেই ড্যাশগুলোর কি বাহার!) আরও নানা ধরনের চিহ্ন দিয়ে যুক্ত করা কথাবার্তা। এমনও আছে, একটা বাক্যতেই একটা বড়সড় প্যারাগ্রাফ হয়ে গেছে। এমনও হয়েছে, পড়তে পড়তে কথার মাঝখানে পৌঁছে ভুলে গেছি প্রথমে কী বলেছে। সেগুলোর জট ছাড়িয়ে সোজা বাংলায় লেখাটা আমার কাছে বড়ই দুষ্কর কাজ মনে হয়েছে, মাঝে মাঝে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়েছে। (ভাগ্য ভালো, আমি ন্যাড়া মাথার ভিক্ষু, নাহলে কী যে হতো ভেবে পাই না!) তবে আমি প্রথমে বুঝতে চেষ্টা করেছি বাক্যটা কী বলতে চাচ্ছে। এরপর ভেবেছি সেটাকে ভেঙে বর্তমানে প্রচলিত সহজ বাংলায় বললে কীভাবে বলা হতো। এরপর ভেবেছি, সহজ ভাষায় লিখতে গিয়ে অর্থের বিকৃতি ঘটছে কিনা, সেটাতে ভুল বুঝার অবকাশ রয়েছে কিনা, (কারো পাকা ধানে মই দিচ্ছি কিনা)। চেষ্টা করেছি সহজ ভাষায় লেখার জন্য। মাসের পর মাস লিখে গেছি। সবসময় মাথার প্রসেসর ভালোমতো লজিক মেনে কাজ করেছে এমন নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি না। তাই ভুলভ্রান্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আশা করছি কোনো ভুলভ্রান্তি ধরা পড়লে নালাগিরি হাতির মতো দয়া নেই, ক্ষমা নেই এমন হবেন না। এই বেচারা অনুবাদকের প্রতি করুণাপরবশ হয়ে সেগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন (এবং যদি আরেকটু দয়া হয় তো ভুলটা একটু দেখিয়ে দিয়ে যাবেন)।

সে যাই হোক, এই বইটা গবেষণাধর্মী একটা বই। মূল বিনয় পিটকের গ্রন্থগুলো, তাদের অর্থকথা এবং টীকা-টিপ্পনী ও অন্যান্য অনেক বইয়ের রেফারেন্স দেখেই বুঝা যায়, লেখক বইটা মজা করার জন্য লেখেন নি। তিনি আধুনিক পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিনয়ের বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন, অস্পষ্টতার আলো-আঁধারিতে লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকা বিনয়ের বিষয়গুলোকে যথাযথ যুক্তিতর্কের আলোয় স্পষ্ট করে তুলেছেন।

যেহেতু বিনয় মানেই হচ্ছে ভিক্ষুদের আইন, তাই এই বইয়ে আইনের মারপ্যাঁচ আছে, কথার মারপ্যাঁচ আছে। পড়তে গেলেই মাথা গরম হয়ে যায়। অর্থাৎ বইটা একবসায় পড়ে ফেলার মতো এতটা সুপাঠ্য নয় মোটেই, বরং ঠেকায় না পড়লে কেউ এই বই না পড়ারই কথা। তবে বিনয় সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে ঠেকায় পড়লে এই বই প্রচুর সাহায্য করবে। আমিও ঠেকায় পড়ে বাধ্য হয়েই এই বইটা পড়েছি। ঠানিস্সারো ভান্তের দাবি, তার এই বইটা আপামর ভিক্ষুদের জন্য, এবং ভিক্ষুদেরকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক উপাসক উপাসিকাদের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য। তার দাবি তিনি করতেই পারেন, কিন্তু বইটি পড়ে (যেহেতু আমার মন আছে, তাই)আমার মনে হয়েছে, বইটা সবার জন্য নয়, শুধুমাত্র ভিক্ষুদের জন্য, এবং তাও একশোজন ভিক্ষুর মধ্যে যে দুএকজন ভিক্ষু বিনয়ের ব্যাপারে আরো খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে চায়, তাদের জন্য। বাদবাকিদের জন্য এর কথাগুলো বুঝা কঠিন হবে, অনেকটা মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে। তবে চেষ্টা করতে দোষ কী?

পড়তে গিয়ে মাথা গরম হওয়ার আরো একটা কারণ হচ্ছে বইটা বেশ দুর্বোধ্য হয়ে গেছে। কথাগুলো সহজ সাবলীল করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করি নি, তবুও কী করে প্যাঁচ লেগে গেল জানি না। আমার পরামর্শ হচ্ছে, যেটা বুঝবেন না সেটা বাদ দিয়ে অন্য কিছু পড়ুন। (আর, না পড়লেও আপনাকে কেউ কিছু বলতে যাবে না।) সোজা কথা হচ্ছে, যেটা বুঝবেন না সেটা নিয়ে বেশি সময় নষ্ট না করে যেটা বুঝতে পারছেন সেটা পড়ে নিন। সবকিছু বুঝতেই হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি!!

সে যাই হোক, বইয়ের মধ্যে অনেক জায়গায়ই দেখতে পাবেন এমন কয়েকটা বাক্য আছে, যেমন- আমি দেখেছি, আমি গবেষণা করেছি, আমি হেন করেছি, আমি তেন করেছি ... প্রিয় পাঠক, আপনাকে বুঝতে হবে এগুলো যা করার করেছেন বইটির মূল লেখক মাননীয় ঠানিস্সারো ভিক্ষু। কাজেই এমন বাক্য দেখলে মনে করতে হবে সেটা তিনিই বলেছেন, সেটা ভালো হোক বা মন্দ হোক, আপনার ভালো লাগুক বা খারাপ লাগুক, তার দোষ এই বেচারা অনুবাদকের ঘাড়ে চাপালে হবে না।

আমার কাছে একটা জিনিস খুব গোলমেলে মনে হয়েছিল, সেটা হচ্ছে- ‘প্রথম বর্ষাবাস সম্পন্নকারী ভিক্ষুরাই কঠিনের বিস্তারের সুবিধাগুলো (কঠিন চীবরের পঞ্চফল) পেতে পারে।’ কথাটা পড়ে প্রথমে আমার নিজেরই খটকা লেগেছে। তার মানে যাদের ভিক্ষুত্বের বয়স পাঁচ বা দশ বা পনের বর্ষা বা আরও বেশি, তারা তাহলে কঠিন চীবরের পঞ্চফল পাবে না নাকি! সমস্যাটা হচ্ছে এখানে প্রথম বর্ষাবাস মানে ভিক্ষুত্বের বয়স যাদের এক বর্ষা, তাদেরকে বুঝাচ্ছে না। এটি বুঝাচ্ছে বর্ষাকালের প্রথম বর্ষাবাসকে। একটা বর্ষাকালে দুটো বর্ষাবাস করা যায়: প্রথম আর দ্বিতীয় বর্ষাবাস। প্রথম বর্ষাবাসটা হচ্ছে বর্ষার প্রথম তিনমাস, আর দ্বিতীয় বর্ষাবাসটা হচ্ছে বর্ষার শেষ তিনমাস। যারা প্রথম বর্ষাবাস করেছে তারাই কঠিন চীবর দানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, দ্বিতীয় বর্ষাবাস যারা পালন করে, তাদের বর্ষাবাস যেদিন শেষ হয়, কঠিন চীবর দানের সময়ও সেদিন শেষ হয়, কাজেই সেখানে কঠিনের বিস্তারে অংশগ্রহণের সুযোগ কোথায়? আর কঠিনের বিস্তারে অংশগ্রহণ না করলে কঠিন বিস্তারের পঞ্চফল পাবে ক্যামনে?

বিনয়ের ছোটখাট বিষয় নিয়েও যে ভিক্ষুসঙ্ঘে মহাগণ্ডগোল হয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে ঠানিস্সারো ভান্তে ভালোই ওয়াকিবহাল আছেন। তাই তিনি বার বার বলেছেন, কোনো প্রচলিত রীতি যদি বিনয়বিরোধী না হয়, তাহলে সেটা রীতি অনুসারে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু যেগুলো বিনয়বিরোধী কাজ, অথচ প্রচলিত রীতি হয়ে গেছে, গা সওয়া হয়ে গেছে, সেগুলোর ব্যাপারে কী করা যায়? আমি জানি, প্রচলিত রীতির বাইরে যাওয়া, যেধরনের বিনয়বিরোধী কাজই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে, সেগুলোর বাইরে যাওয়া ভীষণ কঠিন। কিন্তু প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে বনভান্তে আমাদের মাঝে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। তার জীবনী পড়লেই জানা যায়, বিনয়বিধি মানার বেলায় তিনি সামান্য শিথিলতাও দেখান নি। যতটুকু জেনেছেন, ততটুকু অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন। চিৎমরমের ভান্তে তাকে বলেছিলেন, ভিক্ষু শ্রামণ লোকাল গাড়িতে চড়তে পারে না। ঐ একটা কথাই তার জন্য যথেষ্ট হয়েছে। সেটা তিনি আজীবন পালন করে এসেছেন। এরপর আর লোকাল গাড়িতে চড়েন নি।

সে যাই হোক, কোনো ভিক্ষু যদি দেখে, শোনে বা সন্দেহ করে যে, তার সতীর্থ কেউ কোনো আপত্তি করেছে বা অপরাধ করেছে তাহলে সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় অথবা তা নাহলে অন্য কোনো সতীর্থকে সেবিষয়ে বলতে হয়। কিন্তু সবাই যদি আপত্তিগ্রস্ত হয়ে থাকে, তাহলে কী হবে? আমার একটা কাহিনী মনে পড়ছে। সেটা সত্যি ঘটনা। কোনো এক গ্রামের বিহারের ভিক্ষু সেই গ্রামের এক মেয়ের সাথে ব্যভিচার করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ল। তাকে বিচারের জন্য সালিশ বসল। তার বিচার করার জন্য আশেপাশের গ্রামের বিহারগুলো থেকে আরো কয়েকজন ভিক্ষু উপস্থিত হলো। লোকজন তার বিচারের ভার সেই ভিক্ষুদের হাতে ছেড়ে দিল। বিচারক যেহেতু ভিক্ষুরা, তাই উপস্থিত লোকজনের সামনে তারা বলল, ‘ভিক্ষুটি যেহেতু ব্যভিচাররত অবস্থায় ধরা পড়েছে, তাই তার রংকাপড় কেড়ে নিতে হবে। সে আর ভিক্ষু নয়। সে পারাজিকাগ্রস্ত।’ তা শুনে প্রতিবাদ করে উঠল ধরা পড়া ভিক্ষুটি। সে বিচারক ভিক্ষুদের একজনকে চিনত এবং তার কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে ভালোই জানত। সে লোকজনকে বলল, ‘ব্যভিচারের কারণে যদি রংকাপড় কেড়ে নিতে হয়, তাহলে এই বিচারক ভিক্ষুর রংকাপড় আগে কেড়ে নিতে হবে। কারণ আমি জানি, সে অমুক অমুকের সাথে ব্যভিচার করেছে। সেই মেয়েদেরকে ডাকলেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে।’ বিচারক ভিক্ষুটি এভাবে ধরা খেয়ে অপ্রস্তত হয়ে গেল। লোকজন বলল, ‘ঠিকই তো। আমরা এমন ভিক্ষু চাই না। তাকেও রংকাপড় ত্যাগ করতে হবে।’ সেই বিচারক ভিক্ষু গত্যান্তর না দেখে পাশে বসা আরেক ভিক্ষুকে দেখিয়ে বলল, ‘এও তো ব্যভিচার করেছে। রং কাপড় ছাড়তে হলে তাকেই আগে ছাড়তে বলুন। সে রংকাপড় ছাড়লে আমিও ছাড়ব।’ পাশে বসা ভিক্ষুটি তখন আরেকজনকে দেখিয়ে দিল। এভাবে একজন আরেকজনকে দেখিয়ে দিতে দিতে দেখা গেল উপস্থিত ভিক্ষুদের একজন বাদে সবাই পারাজিকাগ্রস্ত। যে ভিক্ষুটি পারাজিকা করে নি সে বুড়ো বয়সে ভিক্ষু হয়েছিল, কাজেই তার পারাজিকা করার সুযোগ হয় নি হয়তো। এখন সব ভিক্ষুকে কাপড় ছাড়তে বলা হলে আশেপাশের গ্রামগুলোর অনেক বিহার ভিক্ষুশূন্য হয়ে যাবে। লোকজন সেটা চাইল না। তাই তারা সব ভিক্ষুকেই রংকাপড় নিয়ে থাকতে দিল।

এই সত্য ঘটনা থেকে দেখা যায়, সাধারণ লোকজন কোনো ভিক্ষু সুশীল কি দুঃশীল সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামায় না। তাদের একজন ভিক্ষু হলেই হলো। বরং ভিক্ষুদেরকেই বিনয়শীল পালনের দায় নিতে হবে। তাতে নিজেরও উন্নতি এবং শ্রীবৃদ্ধি হবে, ধর্মেরও শ্রীবৃদ্ধি হবে, উপাসক-উপাসিকাদেরও সবদিক দিয়ে মঙ্গল হবে।

এই বই পড়তে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খেতে পারেন অচেনা শব্দগুলো নিয়ে। আপনি দেখবেন এখানে বহুল প্রচলিত শব্দ যেমন- আপত্তি, পরিবাস, মানত্ত, মূলে প্রতিকর্ষণ, আহ্বান ইত্যাদি শব্দের বদলে অনেক জায়গায় অপরাধ, যাচাইপর্ব, প্রায়শ্চিত্ত, শুরুতে ফিরে যাওয়া, পুনর্বাসন ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আমি অনুবাদের শুরু থেকেই দ্বিধান্বিত ছিলাম ঠানিস্সারো ভান্তের শব্দগুলো ব্যবহার করব, নাকি আমাদের প্রচলিত শব্দগুলো ব্যবহার করব। শেষমেষ আমি জগাখিচুড়ি একটা পদ্ধতি অনুসরণ করেছি, কখনো মূল পালি শব্দ ব্যবহার করেছি, কখনো অনূদিত শব্দগুলো ব্যবহার করেছি, যখন যেটা যথাযথ মনে হয়েছে সেই শব্দটাই দিয়েছি। আমি জানি, এটা নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানাবেন, এমনকি করুণাবংশ ভান্তেও এতে আপত্তি জানিয়েছেন, আর আমি তাকে দুয়েকবার বলেছিও যে, এখানে পালি শব্দগুলোই ব্যবহার করব, কারণ আমরা পালি শব্দগুলোর সাথেই পরিচিত, কিন্তু তবুও শেষে কেন যে টুক্যা উল্টালাম, বুঝতে পারছি না।

তো, বইটাতে শেখার মতো প্রচুর জিনিস আছে, বিশেষ করে অর্থকথা ও টীকাগুলো থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই বই না থাকলে হয়তো আমাদের বেশির ভাগেরই সেগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেত। আরেকটা সুবিধা হচ্ছে ঠানিস্সারো ভান্তে এক একটা বিষয়ের সবকিছু একটা জায়গায় কুড়িয়ে এনেছেন। আপনি দেখুন মহাবর্গ ও চুল্লবর্গে একটা বিষয় নিয়ে তথ্য কখনই একজায়গায় পাবেন না, একটা এখানে, আরেকটা ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রীতিমত গবেষণা করে করে তিনি এই আপাতদৃষ্টিতে এলোমেলো বিষয়গুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে তুলে ধরেছেন, যা আমি পড়ি আর অবাক হয়ে যাই, অবাক হয়ে যাই আর ভাবি, বুদ্ধশাসনের জন্য কত কষ্টই না করেছেন তিনি।

আর এর পাশাপাশি বইটা আপনাকে প্রচুর বিতর্কের খোরাক জোগাবে। দয়া করে এই বইটা পড়ে হুট করেই কোনো একটা বিষয় গ্রহণ বা বর্জন করবেন না। তার আগে একটু খোঁজ খবর নিন। প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি রেফারেন্স দিয়েছেন। আগে সেই রেফারেন্সগুলো একটু ঘেঁটে দেখুন, মূল পালিতে, অর্থকথায়, টীকায় কী বলা আছে। তার বুঝার ভুল থাকতে পারে হয়তো, কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণে তেমন কিছু ধরা পড়ে নি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি কথাগুলো বেশ নমনীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন, অন্তর্বাস হাঁটুর আট আঙুলের বেশি নিচে নামানো উচিত নয়। খেয়াল করুন, তিনি এখানে উচিত নয় কথাটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আমি প্রব্রজ্যা হওয়ার পর থেকে উল্টোটা দেখে আসছি। কারণ বনবিহারের ভিক্ষুদের প্রচলিত রীতি হচ্ছে অন্তর্বাস নিচু করে পরতে হবে। বেশি উপরে তুললে, নলাপেট দেখা গেলে তা অভদ্রতা (নলাপেট এর যুতসই বাংলা জানি না, দুঃখিত)। যাই হোক, ঠানিস্সারো ভান্তের মন্তব্য নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলাম কয়েকদিন। এরপর বিনয় পিটকের অর্থকথা সমন্তপাসাদিকা ঘাঁটলাম। পালিতে আমি এখনো নবীন শিক্ষার্থী, হয়তো আমার বুঝার ভুল থাকতে পারে, তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য গেলাম করুণাবংশ ভান্তের কাছে। তিনি যা বুঝিয়ে দিলেন তাতে অর্থকথা আরো এক কাঠি সরেস, অর্থাৎ অন্তর্বাস হাঁটুর আট আঙুল নিচে নামানো যাবে না তো বটেই, নামালে দুক্কট আপত্তিও হবে! শুধুমাত্র নলাপেট যদি দেখতে বিশ্রী হয় তা ঢাকার জন্য নামালে আপত্তি নেই।

এধরনের আরেকটা বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য জমা রেখে খাওয়া।

সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিস্কুট, নানান ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও ফলমূল দান করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে অনেকজন মিলে সেগুলো ধরাধরি করে কোনো একজন ভিক্ষুকে গছিয়ে দেয়। ভিক্ষুটি হাত দিয়ে অথবা লম্বা কোনো বাঁশ দিয়ে সেগুলো স্পর্শ করে। আর লোকজন খুশি হয়ে সাধুবাদ দেয়। এরপর অনুষ্ঠান শেষে সেগুলো বিহারে নিয়ে এসে স্টোরে অথবা ফ্রীজে জমা করে রাখা হয়। পরবর্তী কোনো একদিন বিহারের ভোজনশালায় ভিক্ষুদের খাওয়ার সময় সেগুলো লোকজন আবার গছায়। ভিক্ষুরা তখন আবার সেগুলো গ্রহণ করে এবং খায়। এটাই বর্তমানে বিভিন্ন জায়গার ভিক্ষুদের প্রচলিত রীতি।

প্রিয় পাঠক, একবার কোনো খাদ্যদ্রব্য গছানো হলে সেগুলো হয়তো সেদিনই আবার গছিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু সেগুলো জমা করে রেখে পরের দিন আবার গছিয়ে নিয়ে খাওয়া যায় না। জমা করে রাখা খাদ্য খেলে ৩৮ নং পাচিত্তিয় শিক্ষাপদ ভঙ্গ হয়। না গছানো খাদ্য খেলে ৪০নং পাচিত্তিয় শিক্ষাপদ ভঙ্গ হয়।

বিনয়শীল সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা এবং এখানকার আচার্য পরম্পরা প্রচলিত রীতির কারণে এখনকার ভিক্ষুরা ভাবে, খাদ্যদ্রব্য যতদিন রাখা হোক না কেন, তা কাউকে দিয়ে গছিয়ে খেলে কোনো অসুবিধা নেই। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি, তারা যখন বিস্কুট ও ফলমূল জমা করে খেতে পারছে, তাহলে ভাত তরকারিও রাখে না কেন? নাকি তারা বিস্কুট, ফলমূল এবং ভাত ও তরকারিকে আলাদা শ্রেণির খাদ্য হিসেবে মনে করে? বিনয়ে তো এগুলো সবই একই শ্রেণির। সেগুলো সবই যাবকালিক খাদ্য। আমি একজন প্রায় মহাস্থবিরের কাছাকাছি ভিক্ষুকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বলেছিলেন, ভাত তরকারিও জমা করে রাখা যেত, কিন্তু কথা হচ্ছে সেগুলো অতদিন টিকবে না। বাসি হয়ে যাবে। তাই সেগুলো আমরা জমা করে রাখি না। কী অকাট্য যুক্তি রে বাবা!

সে যাই হোক, আমরা একটু সচেতন হলেই এই শীল লঙ্ঘন করা থেকে বিরত থাকতে পারি। সেটা হচ্ছে এরকম: কোনো একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দানীয় মালামালের মধ্যে যেসব খাদ্যদ্রব্য জমা করে রাখা হবে সেগুলো না গছিয়ে বিহারে পাঠিয়ে দিতে হবে। বিহারের কপ্পিয় কুটিরে সেগুলো জমা রাখা যাবে। সেখান থেকে পরবর্তীতে লোকজন বা শ্রামণরা খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ভিক্ষুদেরকে গছাতে পারবে। এভাবেই খাদ্যদ্রব্য বিহারের মধ্যে কপ্পিয় কুটিরে জমা করে রেখে কোনো শিক্ষাপদ লঙ্ঘন না করেই পরিভোগ করা যায়।

তাই সঙ্ঘ সমবেত হয়ে কপ্পিয় কুটিরের জন্য নির্দিষ্ট যে কর্মবাচা আছে সেটা পাঠ করে বিহারে এমন একটি কপ্পিয় কুটির আগেই নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে। এই কর্মবাচাটা বৌদ্ধ ভিক্ষু বিধি ২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট১ এ দেয়া আছে। কপ্পিয় কুটির বাদে বিহারের অন্য কোথাও খাদ্যদ্রব্য জমা করে রাখাটা মহাবর্গে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

আর সঙ্ঘদানের ক্ষেত্রে সাধারণত বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে কোথাও যদি সঙ্ঘদানের জন্য চারজনের কম ভিক্ষু থাকে তাহলে রাজবনবিহারে ফোন করে সঙ্ঘদানের অনুমতি নিয়ে সঙ্ঘদান করা হয়। সবারই ধারণা যে, সঙ্ঘ না থাকলে অথবা সঙ্ঘের অনুমতি না নিলে সঙ্ঘদান করা যায় না। কিন্তু বিনয় পিটক আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় আমাদের এই ধারণা কতটা ভুল। বিনয় পিটকের ঘটনাগুলো থেকে দেখা যায়, একজনকে দিলেও তা সঙ্ঘদান হয় যদি সেটা সঙ্ঘের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়। সেখানে সঙ্ঘ লাগে না, সঙ্ঘের অনুমতিও নিতে হয় না।

এর প্রমাণ হিসেবে মহাবর্গের চীবর স্কন্ধে একটি ঘটনা আছে যেখানে একজন ভিক্ষু একাকী বসবাস করছিলেন। কিন্তু লোকজন তাকে সঙ্ঘের উদ্দেশ্যে চীবর দান করল। বুদ্ধ তখন সেটা গ্রহণের অনুমোদন করলেন। সেখানে তো সঙ্ঘ ছিল না, সঙ্ঘের অনুমতিও ছিল না। এই উদাহরণটিই আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়, যেখানে সঙ্ঘ নেই সেখানেও এক বা একাধিক ভিক্ষুকে দিয়ে সঙ্ঘের উদ্দেশ্যে সঙ্ঘদান করা যায়, কেননা তারা তো সঙ্ঘেরই অংশ। তাদেরকে দিলে সঙ্ঘকেই দেয়া হয়। শুধুমাত্র দান দেয়ার সময় বলতে হবে যে এই দান সঙ্ঘকে উদ্দেশ্য করে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দাতাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আসল। তারা যদি সঙ্ঘদানের উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক ভিক্ষুকে দানীয় সামগ্রী দান করে, তখন সেগুলো সেই ভিক্ষুদেরই হয়। বিস্তারিত জানতে মহাবর্গের চীবর স্কন্ধ দেখুন।

টাকা-পয়সার গ্রহণ ও লেনদেনের ব্যাপারটা বিনয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই স্পর্শকাতর একটা বিষয়। আমি একদিন রাজবনবিহারের এক রুমে বসে আছি। দুতিনজন বাঙালি যুবক কাঁধে ঝোলা নিয়ে আমার রুমে ঢুকল। ঢুকে খুব বিনীতভাবে দুহাত জোড় করে নমস্কার দিল। তারপর ঝোলা থেকে অক্সফোর্ড ডিকশনারি বের করে বিজ্ঞাপনমার্কা কথাবার্তা শুরু করে দিল। তাদের কথা হচ্ছে, এই ডিকশনারি খুব দামি হলেও আমার প্রতি সদয় হয়ে তারা খুব অল্প দাম রাখবে। কেননা সেটা তাদের সর্বশেষ কপি। বনবিহারের বিভিন্ন রুমে রুমে গিয়ে ভান্তেদের কাছে তারা এর অনেকগুলো কপি বিক্রি করে এসেছে। আমি বললাম, ডিকশনারিটা তো ভাল। আমি নিজেও সেটা ব্যবহার করেছি। তবে এখন আমার পক্ষে এটা কেনা সম্ভব নয়। কারণ আপনারা বোধ হয় জানেন না, আমরা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা টাকা-পয়সা ব্যবহার করি না। আমি সরল মনেই তাদেরকে কথাগুলো বললাম।

কিন্তু যুবকটি দাঁত বের করে সবজান্তার হাসি দিয়ে বলল, সেটা ভান্তে আমরা বিলক্ষণ জানি। তবে সব ভান্তেরাই তো কিছু কিছু রাখে। ঐ যে আছে না, ড্রয়ারে, ব্যাগে, ডায়েরির ফাঁকে! তার কথা শুনে আমি বেশ অপ্রস্তুত বোধ করলাম। পরে কোনোমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদেরকে বিদায় করে দিলাম।

নিস্সগ্গিয় পাচিত্তিয় ১৮, ১৯ ও ২০ অনুসারে একজন ভিক্ষু টাকা পয়সা নিজের কাছে বা নিজের অধিকারে রাখতে পারে না। সেই টাকা দিয়ে কোনো একটা জিনিস কিনলে সেটা তার জন্য তো অকপ্পিয় বটেই, বাদবাকি সকল ভিক্ষুদের জন্যও সেই জিনিসটি অকপ্পিয়, অর্থাৎ ব্যবহারের অযোগ্য। সমন্তপাসাদিকায় একটা উদাহরণ দেওয়া হয়েছে এভাবে:

কোনো ভিক্ষু টাকা গ্রহণ করে সেটা দিয়ে খনি থেকে লোহার আকরিক তুলে কামারকে দিয়ে ভিক্ষাপাত্র বানায়। সেই পাত্র তখন মহা অকপ্পিয় হয়। কোনো উপায়েই সেটাকে আর কপ্পিয় করা যায় না। সেই পাত্র ভেঙেচুরে যদি দা বানানো হয়, সেই দা দিয়ে দাঁতের কাঠি কাটলে সেই দাঁতের কাঠিও অকপ্পিয় হয়ে যায়। সেই পাত্র ভেঙেচুরে যদি বড়শি বানানো হয়, সেই বড়শিতে ধরা মাছও অকপ্পিয় হয়। সেই লোহার পাত্রে যদি পানি বা দুধ গরম করা হয়, সেই পানি বা দুধও অকপ্পিয় হয়।

অর্থাৎ ভিক্ষুর গৃহীত টাকায় একটা কিছু কিনলে সেই জিনিস থেকে যা কিছু পাওয়া যায় তা সবই অকপ্পিয় হয়ে যায়। এই বিষয়টি কিন্তু সুদূর প্রসারী, কেননা ভিক্ষুরা ফাঙে গেলে সেখানে উৎসর্গের সময় কিছু টাকা পাওয়া যায়। বিহারে ফিরে আসলে সেই টাকাটা বিহারের মধ্যে কোনো ড্রয়ারে, বা ব্যাগে জমা রাখা হয় কোনো ভিক্ষুর দায়িত্বে। ঐ টাকাটা তখন অকপ্পিয়, আর যে ভিক্ষু ঐ টাকাটা রাখে তার নিস্সগ্গিয় পাচিত্তিয় আপত্তি হয়। এই আপত্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তার প্রথমে সেই টাকাটা সঙ্ঘের কাছে বিসর্জন দিতে হয়, এরপর আপত্তি দেশনা করতে হয়। টাকাটা বিসর্জন না দিয়ে আপত্তি দেশনা করার কোনো নিয়ম বা দৃষ্টান্ত বিনয়পিটকে দেখা যায় না। তাই কেউ যদি টাকা রেখে দিয়েই আপত্তি দেশনা করে নিজেকে আপত্তিমুক্ত বলে মনে করে, সেটা তার ভুল ধারণা মাত্র। যে জিনিসের জন্য তার আপত্তি, সেই অকপ্পিয় আপত্তিকর জিনিসটি বহাল তবিয়তে নিজের কাছে রেখে দিয়ে কীভাবে সে নিজেকে আপত্তিমুক্ত বলে ভাবতে পারে?

সেই টাকা দিয়ে সে যদি কোনো মোবাইল বা কম্পিউটার কেনে, অথবা বই কেনে, সেগুলো সবই তার জন্য অকপ্পিয় হয়ে যায়, অন্য ভিক্ষুরাও সেগুলো ব্যবহার করতে পারে না। ফেরত দেয়া ব্যতীত কোনোভাবেই সেগুলোকে আর কপ্পিয় করা যায় না।

সমন্তপাসাদিকার রূপিয়সিক্খাপদ বর্ণনায় উল্লেখ আছে, সেই টাকা দিয়ে যদি উপোসথশালা, ভোজনশালা নির্মাণ করা হয়, তাও ব্যবহার করা ঠিক নয়, এমনকি সেই ঘরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকাও অনুপযুক্ত। সেই টাকা দিয়ে নির্মিত রাস্তা, সেতু, নৌকা ইত্যাদিতে যাওয়াও অনুপযুক্ত। সেই টাকা দিয়ে পুকুর খনন করা হলে সেই পুকুরের জল খাওয়া বা ব্যবহার করাও অনুপযুক্ত। এজন্যই বার্মার বিখ্যাত ধ্যানাচার্য পা-অক সেয়াদ তার বইগুলো ছাপানোর কাজে যাতে কোনোভাবেই ভিক্ষুদের সংগৃহীত টাকা বা ভিক্ষুদের নির্দেশিত টাকা ব্যবহৃত না হয় সেব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেন। কিন্তু এযুগে অখণ্ডভাবে প্রাচীন থেরদের মতবাদ অনুযায়ী লজ্জী ভিক্ষু হয়ে চলা যে চাট্টিখানি ব্যাপার নয় তা আমি বেশ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তবুও বিনয়-গারবী ভিক্ষুদের অবগতির জন্য এই কথাগুলো উত্থাপন করলাম।

এই বইয়ের রেফারেন্সের ব্যাপারে একটা কথা বলি। ঠানিস্সারো ভান্তে ত্রিপিটকের রেফারেন্স দিয়েছেন লন্ডনের পালি টেক্সট সোসাইটির বইগুলো থেকে। কিন্তু আমাদের সবার কাছে সেগুলো সহজলভ্য নয়, তাই আমি বার্মার ষষ্ঠ সঙ্গায়নের যে ত্রিপিটক পাওয়া যাচ্ছে সেটা থেকে রেফারেন্স দিয়েছি, সেটা এখন মোবাইল, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটেও পাওয়া যায়। আর সেটাই শ্রদ্ধেয় করুণাবংশ ভান্তে সুলভ মূল্যে প্রিন্ট করে আমাদের কাছে আরো সহজলভ্য করে দিয়েছেন।

আমার ইচ্ছা ছিল পালি পিটকের রেফারেন্স না দিয়ে বাংলা অনুবাদগুলোর রেফারেন্স দেয়া। কিন্তু বিনয় পিটকের বাংলায় অনূদিত বইগুলো আমার কাছে এতই হযবরল লেগেছে, বিশেষ করে পরিবার গ্রন্থটির আগা-মাথা কিছুই আমার মাথায় ঢোকে না, তাই আমি আর অত ঝামেলায় যাই নি। ঐ ষষ্ঠ সঙ্গায়নের পালি ত্রিপিটকের রেফারেন্স দিয়েছি। আমি জানি, যাদের কাছে কম্পিউটার নেই, অথবা মোবাইল নেই, আর থাকলেও হয়তো পালি জানেন না, তাদের কাছে এমন রেফারেন্স থাকলেও হয়তো চেক করে দেখতে পারবেন না, যেটা বাংলা অনুবাদের রেফারেন্স দিলে পারা যেত। কিন্তু কী আর করা! সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না।

সবশেষে একটুখানি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পালা। এই বইয়ের জন্য প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় মূল লেখক শ্রদ্ধেয় ঠানিস্সারো ভান্তেকে। তিনি দয়া করে নিঃশর্তে এবং নিঃস্বার্থভাবে এই বইটি অনুবাদের অনুমতি না দিলে এই বই খুব সম্ভবত আলোর মুখ দেখত না।

এরপরে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় শ্রদ্ধেয় করুণাবংশ ভান্তেকে। তিনি একাধারে আমার পালি শিক্ষাগুরু, আমার অনেকগুলো উদ্ভট প্রকল্পের সহৃদয় পৃষ্ঠপোষক, এবং পরম শুভাকাঙ্খী কল্যাণমিত্র। তিনিই আমাকে এই বইটি অনুবাদের অনুপ্রেরনা যুগিয়েছেন। তার অনুপ্রেরণা ছাড়া এই বই অনুবাদের ইচ্ছা আমার মনের মধ্যেই ঘুমিয়ে যেত।

বই লেখালেখির ব্যাপারটা সাদামাটা মনে হলেও আদতে সেরকম নয়। তার জন্য অনেক কিছু লাগে, এবং বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, এতে কমপক্ষে কয়েকশ জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা লাগে। আমি যেহেতু বেশিরভাগ সময় কম্পিউটারে লিখতেই অভ্যস্ত, তাই লেখালেখির জন্য একটা কম্পিউটার প্রায়সময় দরকার লেগেছে। সেটার জন্য বিভিন্নসময়ে আমি শ্রদ্ধেয় করুণাবংশ ভান্তের ল্যাপটপটা ব্যবহার করেছি। মাঝখানে আমার এক পরিচিত উপাসক মঙ্গলশান্তি চাকমার কম্পিউটারটা ব্যবহার করেছি। বইটির একটি বিরাট অংশ লিখেছি শাসনহিত শ্রামণের দেয়া ল্যাপটপে। আরো হয়তো অন্যান্য অনেকের কম্পিউটার ব্যবহার করেছি মাঝেমধ্যে, যা এখন মনে পড়ছে না। তাদের সবার প্রতি রইল আমার অসীম মহাবিশ্বভরা কৃতজ্ঞতা।

কম্পিউটারে লিখতে লিখতে বিরক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে দুয়েক মাস খাতায় লিখেছি। তার জন্য বিশাল বিশাল সাইজের খাতা (একেকটার ওজন কমসেকম আধা কেজি হবে মনে হয়!), কলম ইত্যাদি যা যা লেগেছে, শ্রদ্ধেয় করুণাবংশ ভান্তেকে বলতেই তিনি নির্দ্বিধায় সেগুলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একজন লেখকের পক্ষে এমন সহায়তা, এমন পৃষ্ঠপোষকতা যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা আমি প্রায়ই উপলদ্ধি করি। তাই তার জন্য রইল আরো আরো কৃতজ্ঞতা।

অনেকের কাছ থেকে অনেকগুলো ডিকশনারি ধার নিয়ে ব্যবহার করেছি। বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় বিপুলানন্দ ভান্তের ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারিটা একেবারে “ঝুরুটুরু” বানিয়ে ছেড়েছি (অর্থাৎ ছিঁড়ে দিয়েছি!)। অন্য কেউ হলে নিশ্চিত রাগ করত, কিন্তু তিনি মনে হয় তাতে খুশিই হয়েছেন, কারণ সেটা অন্তত ভালো একটা বইয়ের কাজে লেগেছে! তাই এমন মহান ভান্তের প্রতি রইল আমার অপরিসীম কৃতজ্ঞতা। শ্রদ্ধেয় মেধঙ্কর ভান্তের কাছ থেকে এনেছি “সমার্থক শব্দকোষ” বইটি। সেটা আমার এত কাজে লেগেছে যে বলার মতো নয়। এখনো সেটা আমার বিশুদ্ধি মার্গের অনুবাদের কাজে লাগছে। তার প্রতিও রইল অসংখ্য কৃতজ্ঞতা।

বড় বড় অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি কম্পোজ করে দিয়েছে শাসনহিত শ্রামণ। আগে আমার ধারণা ছিল আমাদের ভিক্ষুশ্রামণদের মধ্যে টাইপিং স্পীডে আমার চেয়ে বেশি পারবে না কেউ। কিন্তু তার রকেটের বেগে টাইপিং দেখে আমি লজ্জা পেয়েছি! এই বইয়ের বেশির ভাগ কম্পোজ সেই করে দিয়েছে। সাধুবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল শাসনহিতের জন্য।

এরপরে প্রুফ দেখার পালা, যা খুবই বিরক্তিকর একটা কাজ এবং আমি এটা থেকে হাজার মাইল দূরে থাকতে পছন্দ করি। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, শ্রদ্ধেয় বিধুর ভান্তে এবং শ্রদ্ধেয় করুণাবংশ ভান্তে তা নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়েছেন। প্রুফ দেখার ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় সুভূতি ভান্তেকে এব্যাপারে নিঃসন্দেহে প্রবাদপ্রতিম বলা চলে। তিনি পরম ধৈর্য সহকারে বাক্যের গহীন বনে লুকিয়ে থাকা খুঁতগুলোকে এমন নিখুঁতভাবে খুঁজে বের করে এনেছেন যা করার মতো অন্য কেউ এই দুনিয়াতে আর পয়দা হয় নি বলে আমি নিশ্চিত। তা ছাড়াও, শ্রদ্ধেয় করুণাবংশ ভান্তে এই বইয়ের অঙ্গসজ্জা, ডিজাইন, ট্রেসিং ইত্যাদি যেসব কাজ প্রেসে দেয়ার আগে করতে হয় সেগুলো নিজ দায়িত্বে করে দিয়েছেন পরম মমতায়। যদি কোনো শেষ বিচারের দিন আসে, সেদিন এই বইয়ের প্রত্যেকটি পাতা তাদের এমন মহান হৃদয়ের সাক্ষী হয়ে থাকবে, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। অপরিসীম কৃতজ্ঞতা রইল তাদের সবার কাছে।

এরপরে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয় আমার প্রাণপ্রিয় সতীর্থ বিমুক্তিসার ভিক্ষু ও বিমলজ্যোতি ভিক্ষুকে। আমার প্রত্যেকটি কাজে তারা এত উৎসাহ নিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, আমার কাছে তা খুব অবাক লাগে। এত সহজ সরল কেউ হয়! এত পরোপকারী কেউ হয়! (চুপি চুপি বলে নিই, আমি বুদ্ধের একজন কট্টর অনুসারী। আর বুদ্ধ যেহেতু স্বার্থপর, তাই আমাকেও স্বার্থপর হতে হয়েছে। এখন তাই কাউকে পরোপকারী কাজ করতে দেখলেই আমার সন্দেহ হয়। স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করে নাকি এই দুনিয়ায়? বেটা নিশ্চয়ই কোনো ধান্দায় আছে! সে যাই হোক,) বিমুক্তিসার এবং বিমলজ্যোতি, অশেষ অশেষ সাধুবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল তোমাদের জন্য। যুগ যুগ জিয়ে মেরে লিয়ে!

আর অন্যান্য যেসমস্ত ভিক্ষুশ্রামণ ও উপাসক উপাসিকা আমাকে বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে, সহায়তা দিয়ে এই অনুবাদের কাজে সাহায্য সহায়তা করেছেন তাদের প্রতি আমার সবিনয় কৃতজ্ঞতা রইল। আশা করি, সবার সহযোগিতায় আমরা বিনয়ের সুন্দর একটি বই আগ্রহী সবার কাছে তুলে ধরতে পারছি।

অনুবাদের পরে এবার তা প্রকাশের ব্যাপারে একটু বলি। বই ছাপানো বিশাল খরচের ব্যাপার, বিশেষ করে এত বড় বড় দুটো বই। ১০০০ কপি ছাপাতে গেলেই নাকি ৪/৫ লাখ টাকা লাগবে। সে যাই হোক, বইটাকে যেহেতু আমি ভিক্ষুদের বিনয় শিক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মনে করি, এবং আরো মনে করি যে, প্রত্যেক ভিক্ষুরই এক কপি করে এই বইটা পাওয়া উচিত, তাই আমার ইচ্ছা ছিল বইটা বিনামূল্যে বিতরণ করে দেয়ার জন্য। সেটা আমার এবং প্রকাশকবৃন্দের অসীম পুণ্য লাভের হেতু হবে। আমার এই ইচ্ছার কথা শ্রদ্ধেয় বিধুর ভান্তেকে বলতেই তিনি বইটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে তা ছাপানোর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিলেন। পরে জানলাম, এবছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের বর্ষায় যারা মহাস্থবির হচ্ছেন তারা বইটির প্রথম খণ্ড ছাপাবেন এবং যারা স্থবির হচ্ছেন তারা বইটির দ্বিতীয় খণ্ড ছাপাবেন। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে বিনয়ের প্রচার ও অনুশীলনে তাদের এমন সহায়তার জন্য আমি তাদের প্রতি এবং সংশ্লিষ্ট উপাসক-উপাসিকা ও সহায়তাকারীদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। আশা করি আমাদের বিনয় সংক্রান্ত অনেক কৌতুহল এই বইটি মেটাতে সক্ষম হবে। বিনয়ের চর্চা আরো বাড়ুক এই কামনা করে শেষ করছি।

এই পুণ্য আমাদের সবার অতিসত্বর নির্বাণ লাভে সহায়ক হোক।

জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু

করুণাপুর বন বিহার, বালাঘাটা, বান্দরবান

১৫ অক্টোবর, ২০১৫

সূ চি প ত্র

50cvwifvwlK kã......

52মুখবন্ধ

54ভূমিকা

57বিন্যাস

58বিধিবিধান

60আলোচনা

64প্রথম অংশ

64সাধারণ বিষয়াবwল

66অধ্যায় - ১

66ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অংশ

66গোসল

69দাঁতের যত্ন

69চুলের যত্ন

70দাড়ি

71মুখ

72দেহের লোম বা কেশ

73নখ

74কান

74অলsKvর বা সাজসজ্জা

74বিধিবিধান

74গোসল

75দাঁতের যত্ন

76মাথার চুল

76দাড়ি ও দেহের কেশ/লোম

77মুখ

77নখ

78কান

78অলsKvর

79অধ্যায় - ২

79কাপড়ের দ্রব্যসামগ্রী

82চীবর-কাপড়

84চীবর সেলাইয়ের নিয়ম

87চীবর মেরামত করা

88চীবর সেলাইয়ের সরঞ্জাম

91চীবর রs করা

93চীবর ধোয়া

94অন্যান্য কাপড়ের দ্রব্যসামগ্রী

96পোশাক পরিধান করা

102বিধিবিধান

102কাপড়ের প্রকারভেদ

102কাপড় লাভ করা

102শ্মশানে ছিন্নবস্ত্র সংগ্রহ করা

103অধিষ্ঠান/অংশীদারি মালিকানা

103অতিরিক্ত চীবর-কাপড়

104চীবর সেলাইয়ের নিয়ম

105অন্যান্য কাপড়ের দ্রব্য বানানো

106চীবর সেলাইয়ের সরঞ্জাম

109চীবর রং করা

109পোশাক পরা

113অধ্যায় - ৩

113ভিক্ষাপাত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র

113ভিক্ষাপাত্র

118জুতা/স্যান্ডেল

121জলছাঁকনি

123বিবিধ জিনিসপত্র

125বিধিবিধান

125ছাবেক

127জুতা/স্যান্ডেল

129জলছাঁকনি

129বিবিধ

132অধ্যায় - ৪

132খাদ্য

132খাদ্য রান্না করা এবং জমা করা

134খাওয়া

135দুর্ভিক্ষকালীন অনুমোদন

136রসুন

136মুগডাল

137বিধিবিধান

138রান্না করা ও জমা রাখা

139খাওয়া

140দুর্ভিক্ষকালীন অনুমোদন

142দ্বিতীয় সঙ্গীতি থেকে

145অধ্যায় - ৫

145ওষুধপত্র

150মৌলিক সহায়ক ওষুধ

151আজীবনের ওষুধ

154বিশেষ চিকিৎসা

160চিকিৎসা পদ্ধতি

162মহান মানদণ্ড

162বিধিবিধান

162পঞ্চ ভৈষজ্য

163আজীবনের ওষুধ

165বিশেষ চিকিৎসা

168চিকিৎসা পদ্ধতি

169মহান মানদণ্ড

170অধ্যায় - ৬

170বাসস্থান

170বাইরের বিশ্রামস্থল

171আবাস

176আসবাবপত্র

183বাসস্থানের ব্যাপারে শিষ্টাচারবিধি

185বিধিবিধান

185আবাস

188আসবাবপত্র

191বাসস্থানের ব্যাপারে শিষ্টাচার

193অধ্যায় - ৭

193বিহারের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি

193বিহার

194ঘরবাড়ি

201বিহারের সম্পত্তি

205চৈত্য সম্পত্তি

205বিধিবিধান

205সম্মেলন কক্ষ

206খাওয়ার পানির হল

206অগ্নিশালা

207খাদ্যস্টোর

207চ¼«মণ-পথ

208কুয়া

209উষ্ণ স্নানঘর

211কঠিনের হলঘর

211গোসলখানা ও টয়লেট (আরও দেখুন : শিষ্টাচারবিধি, অধ্যায় ৯)

214ঘেরা/দেয়াল

215সাংঘিক জিনিসপত্র

217অধ্যায় - ৮

217শ্রদ্ধা

219শ্রদ্ধা জানানো

219ধর্মশিক্ষা দেওয়া

222সিনিয়রিটি বা জ্যেষ্ঠতা

227সিনিয়রিটির ব্যতিক্রম

229সমালোচনায় প্রতিক্রিয়া দেখানো

229হাসিঠাট্টা

230বিধিবিধান

230শ্রদ্ধা জানানো

230ধর্মশিক্ষা দেওয়া

231সিনিয়রিটি বা জ্যেষ্ঠতা

232সিনিয়রিটি বা জ্যেষ্ঠতার ব্যতিক্রম

235অধ্যায় - ৯

235শিষ্টাচারবিধি

238আগমনকারী ভিক্ষুর শিষ্টাচারবিধি

243আবাসিক ভিক্ষুর শিষ্টাচারবিধি

245গমনকারী ভিক্ষুর শিষ্টাচারবিধি

247অনুমোদনের শিষ্টাচারবিধি

248ভোজনশালার শিষ্টাচারবিধি

251পিণ্ডচারণের শিষ্টাচারবিধি

253আরণ্যিক শিষ্টাচারবিধি

256বাসস্থানের শিষ্টাচারবিধি

257উষ্ণ স্নানাগারের শিষ্টাচারবিধি

259টয়লেটের শিষ্টাচারবিধি

261উপাধ্যায়ের প্রতি শিষ্টাচারবিধি

270শিষ্যের প্রতি শিষ্টাচারবিধি

272চুল্লৰগ্গ ৪৫৭

273অধ্যায় - ১০

273অসদাচরণ

273খারাপ অভ্যাস

282মিথ্যা জীবিকা

294নিষ্ঠুরতা

294ধ্বংসাত্মক আচরণ

295আত্ম-অঙ্গচ্ছেদ

296মন্ত্র ও নিমিত্ত বা পূর্বলক্ষণ

299অলৌকিক শক্তি দেখানো

302নিষিদ্ধ বিষয়

302বিধিবিধান

302খারাপ অভ্যাস

303মিথ্যা জীবিকা

304নিষ্ঠুর আচরণ

305ধ্বংসাত্মক আচরণ

305আত্ম-অঙ্গচ্ছেদ

305মন্ত্র ও নিমিত্ত বা পূর্বলক্ষণ

307অলৌকিক শক্তি

308অধ্যায় - ১১

308বর্ষাবাস

308বর্ষাবাসের সময়

309বর্ষাতে প্রবেশ করা

313প্রতিkÖæতি ভঙ্গ করা

314অধিষ্ঠান

315সময়সীমা

315সাতদিনের কাজ

320প্রতিবন্ধকতা

323অধর্মত ঐকমত্য

325কাপড় দান

326বিশেষ সুবিধা

329বিধিবিধান

329জায়গা

330প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা

332সাতদিনের কাজ

338বর্ষা না ভেঙে চলে যাওয়া

341অধর্মত ঐকমত্য

342কাপড়-দান

343অন্যান্য সুবিধা

345দ্বিতীয় অংশ

347অধ্যায় - ১২

347সংঘকর্ম

350লক্ষ্যবস্তুর বৈধতা

351কর্মবাক্যের বৈধতা

353সভার বৈধতা

355সীমার বৈধতা

362অপরাধ

363বিধিবিধান

363বিষয়

369মিটমাটের পদ্ধতি

369সামনাসামনি

369স্মৃতি

370অতীত উন্মত্ততা

371স্বীকারোক্তি অনুসারে

371সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুসারে

372আরও-শাস্তিকর্ম

373ঘাস দিয়ে ঢাকার মতো করে ঢেকে দেওয়া

373সংঘকর্ম

380কোরাম

383সম্মতি

385প্রতিবাদ

386অধ্যায় - ১৩

386সীমা

389অবদ্ধ সীমা

393বদ্ধ-সীমা

396সীমানা চিহ্ন

401সীমা নির্ধারণ পদ্ধতি

405খণ্ডসীমা

407সীমা বাতিল করা

408সংক্ষেপিত তালিকা

410সীমার বৈধতা

411বিধিবিধান

411অবদ্ধ-সীমা